এ সময়ের বিয়ের সাজ
কনের বিয়ের সাজ; অন্তত তিনবার তো হবেই, তাই না? গায়েহলুদ, বিয়ে আর বউভাত এই তিন মূল অনুষ্ঠান নিয়েই বাঙালি বিয়ে। কারও কারও বাগদানের মতো আয়োজনগুলোও আলাদা করে হয়। বিয়ে এমনই এক উৎসব, যা নিয়ে একদম কিচ্ছুটি না ভাবা পাত্র-পাত্রীর মনেও ভাবনা খেলে যায়, কেমন দেখাবে তাকে বিয়েতে! তিন আয়োজনের মধ্যে বিয়ের সাজপোশাক নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবনা খেলা করে বর-কনের মনে। কেমন চলছে এখন বিয়ের সাজপোশাক।
দেশি শাড়িতেই নতুনত্ব-
যদিও মূল্য দিয়ে কিনতে হয় তবুও বিয়ে মানেই মেয়েদের প্রধান অমূল্য সম্পদ বিয়ের শাড়ি। মাঝে বেনারসি-কাতানের বদলে জর্জেটের ওপর জরি-চুমকি আর সোনালি সুতার কাজ প্রাধান্য পেয়েছিল। এখন আবার ঘুরে ঘুরে কাতান-বেনারসি। জামদানিও উঁকি দেয় কালেভদ্রে। ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘বিয়েতে এখন শাড়ি, লেহেঙ্গা, ঘাগড়া পরা হলেও শাড়ির আবেদনটাই অন্যরকম। এখন কনেদের দেশি বিয়ের শাড়ির প্রতি আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এ তালিকায় যেমন রয়েছে বেনারসি, মিরপুরের কাতান, সিল্ক তেমনি জামদানিও। দেশি শাড়িতে সোনালি সুতার ট্রেডিশনাল নকশাটাই এখন বেশি দেখা যায়।’
বিয়ের সাজে সতেজতা-
ষাটের দশকের শুরুর দিকে বিয়ের সাজে দেখা যেত বেনারসি শাড়ি, চুল খোঁপা করা, গাঢ় কাজল আর কপাল থেকে গালে নেমে আসা স্নোর ফোঁটা। সত্তর দশকের দিকে বিয়েতে বড় নথ, ঝাপটা পরার চল ছিল। তবে সাজ ছিল খুবই কম। বাদামি আইশ্যাডো, একটু কাজল আর লাল লিপস্টিক এতেই বিয়ের কনের প্রস্তুত। এই দুই দশকের সাজের প্রভাব ঘুরেফিরে এখনকার কনের সাজে লক্ষ করা যায়। ষাটের দশকের বেনারসি, কাতান যেমন এখনকার ট্রেন্ড তেমনি সত্তরের দশকের হালকা বিয়ের সাজ এখন কনের পছন্দের ন্যাচারাল লুক। আধুনিক কনের গহনা ও পোশাক যত ভারীই হোক না কেন, সাজ হবে হালকা ও সতেজ।
রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান বলেন, ‘এখন হলদু, বিয়ে, বউভাত সব প্রোগ্রামেই বেশ আয়োজন করে করা হয়। এ ক্ষেত্রে কনেকে একেক দিন একেক সাজে দেখা যায়। তবে প্রতিটা মেকআপেই হালকা ও সতেজ একটা লুক ফুটে ওঠে। মেকআপ খুব বেশি শাইনিংও করা হয় না। কনট্যুরিং এবং ব্লাশনের ব্যবহারও খুব হালকাভাবেই করা হচ্ছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ব্যবহার করছেন। লাল তো আছেই। বাঙ্গি, বাদামি ও গোলাপির হালকা শেডগুলো বেছে নেওয়া হচ্ছে পোশাক মিলিয়ে। এ ক্ষেত্রে চোখের সাজটা গাঢ় করে তোলা হচ্ছে। আবার গাঢ় লিপস্টিকের সঙ্গে ন্যাচারাল আইশ্যাডো ব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করা হচ্ছে আই ভ্রু।’ আধুনিক কনে সাজে চোখের স্মোকি সাজ এখন আর চলতি ধারায় নেই। তবে আইশ্যাডোতে সোনালি গ্লিটারের ব্যবহার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ কাজল দিচ্ছেন চোখ ভরে। কনেরা পরছেন পেস্টাল, কোরাল ও লালচে বিয়ের পোশাক। ফলে মেকআপও মাঝে মাঝে কোরাল ও পেস্টাল করতে দেখা যায়। ব্রাউন আই ভ্রু পেন্সিল কিংবা ম্যাট আইশ্যাডো মোটা করে আই ভ্রু আর্ট করা হচ্ছে।
খোঁপা কিংবা বেণিজুড়ে ফুল-
কনেরা এখন আর পাঁক করে খোঁপা করছেন না। বরং চেপ্টা করে চুল আঁচড়িয়ে খোঁপা করছেন, জানালেন মিউনিজ ব্রাইডালের কর্ণধার ও বিউটি এক্সপার্ট তানজিমা শারমিন মিউনি। বললেন, ‘চুলে খোঁপা বাঁধা বিয়ের দিন এখন জনপ্রিয়। মাঝে মাথাজুড়ে থাকছে সিঁথিপাটি। খোঁপা কিংবা বেণিজুড়ে থাকছে মন মাতানো জুঁই, অর্কিড, জিনিয়া।’ মাথাভর্তি করে ফুল পরার চলও আগেও ছিল। অভিনেত্রী আনুশকার কারণে সেটি যেন আরও জনপ্রিয়।
নতুনরূপে পুরনো গহনা-
একটা সময় পর্যন্ত ভাবাই যেত না বিয়ের দিনে বউয়ের গায়ে সোনা ছাড়া ইমিটেশনের গহনা উঠবে। এখন কিন্তু বিয়েতে প্রাধান্য পাচ্ছে সোনার বাইরেও সোনার প্রলেপ দেওয়া বা ভিন্ন ভিন্ন ধাতুর তৈরি ঐতিহ্যবাহী নকশার গহনা। কাটা কাজের নকশা, গলাজুড়ে ভরাট নকশা, মিসরীয় সভ্যতার গহনার নকশা এখন শোভা পায় আধুনিক কনের গহনাতে।
বরের সাজ-
বরবেশে বিয়েতে বরের সাজও এখন কম যায় না। বরের পোশাক এখন একই ধরনের রঙ থেকে বেরিয়ে আরও বর্ণিল হয়েছে। লাল ছাড়াও মেরুন, নীল, সোনালি, গোলাপি, ফিরোজা, সবুজ বা কালো রঙের বরের পোশাক দেখা যাবে বিয়ের মৌসুমজুড়ে। নকশা আর কাটেও থাকবে নতুন কিছু। ফ্যাশন হাউস ইজির কর্ণধার ও ফ্যাশন ডিজাইনার তৌহিদ চৌধুরী বলেন, ‘শেরওয়ানিতে এবার বেশি থাকবে হাতের কাজ। তাতে মোটিফ হিসেবে দেখা যাবে ফুল, পাখিসহ নানারকম প্রাণীর নকশা। কাতান কাপড়ের শেরওয়ানির কলার আর বোতামে সূক্ষ্ম জরি সুতার কাজ ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে।
শেরওয়ানিতে অনেক ধরনের প্যাটার্ন বা কাটের চল চলে এলেও বর্তমানে স্লিম কাট এবং সেমি লম্বার চলটাই বেশি দেখা যাচ্ছে। ফ্লোরাল প্রিন্টের কাতান বা সিল্ক কাপড়ের শেরওয়ানির সঙ্গে ভালো লাগবে আলিগড় পায়জামা। জ্যাকার্ড তাঁতে বোনা শেরওয়ানির সঙ্গে পরতে পারেন চুড়িদার। শেরওয়ানির সঙ্গে নাগরার বদলে ভিন্নতা আনবে স্যান্ডেল।’ রাজকীয় বর সাজার ইচ্ছা থাকলে শেরওয়ানির সঙ্গে মিলিয়ে দোপাট্টা নিন। জর্জেট কাপড়ের দোপাট্টায় রেশমি সুতার কাজ আর নিচে ছোট ছোট পাথর বসানো ঝালর দেওয়া দোপাট্টা, মুক্তার মালা শেরওয়ানি রাজকীয় লুক আনবে।
বর সাজতে হলে ভারী শেরওয়ানি পরতে হবে এমনও নয়। ফুল আর পাখির নকশা করা প্রিন্স কোট পরেও ভিন্ন বেশে বর সাজতে পারেন। অভিনবত্ব চাইলে যোধপুরি প্যান্টের সঙ্গে প্রিন্স কোট পরুন। বর সাজতে পারেন স্যুট-বুটেও। সেখানে কালো থেকে বেরিয়ে নীল, ছাইরঙা বা খয়েরি দেখা যাবে। অনুষঙ্গ হিসেবে কোটপিন, টাই, বো, পকেট স্কয়ার জুতার প্রতি বিশেষ নজর থাকতে হবে। সঙ্গে এক জোড়া কাফলিংস পরে নিন। বরের সাজটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। সনাতন ধর্মের বর শেরওয়ানি ছাড়াও তসর, সিল্কের ভারী কাজের পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি, দোপাট্টা পরতে পারেন। মাথায় পাগড়ির বদলে থাকুক শোলার টোপর।
বরের পাগড়ি-
বিয়ের পাগড়ি বরের অলঙ্কারের মতো। এই পাগড়ি পরার ঐতিহ্য প্রাচীন। তবে পাগড়ি পরার নকশা এবং রঙে এখন ব্যাপক বৈচিত্র্য এসেছে। কেনা পাগড়ির বদলে হাতে বাঁধা পাগড়িতে বিয়ের সাজে আসে ভিন্নতা। সোনালি, তামাটে, লালের মতো উজ্জ্বল রঙ কিংবা ঘিয়ে রঙের পাগড়িতে বর বেশি জমকালো হয়ে ওঠে। আর তা যদি হয় জামদানি, কাতান, মসলিন, হাফসিল্ক কাপড়ের তবে তা আরও চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। বরের সাজে নতুনত্ব আনতে ভারতের রাজস্থান, বেলুচ, হায়দরাবাদ কিংবা মোগল পাগড়ি এখন বেশি জনপ্রিয়।
সূত্রঃ দৈনিক আমাদের সময়
ছবিঃ সংগৃহীত