বয়সভেদে ব্যায়াম

বয়সভেদে ব্যায়াম

সুস্থ থাকতে আমাদের পুষ্টিকর খাবার, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়মিত ব্যায়াম করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুত হাঁটার বা ৭৫ মিনিট দৌড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। তাই প্রতিদিন সম্ভব না হলেও সপ্তাহে ৫-৬ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত।

 

ব্যায়ামের ফলটা খুব ধীরগতিসম্পন্ন, যে জন্য মানুষ এটার প্রতি আকৃষ্ট কম হয়। কিন্তু সুস্থ–সবল জীবন যাপন করতে চাইলে ব্যায়ামকে নিত্যদিনের রুটিনে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

 

বয়সভেদে ব্যায়াম-

বয়সের তারতম্য এবং শারীরিক সুস্থতার ওপর ব্যায়ামের পরিমাণ নির্ভর করে। বয়সভেদে ব্যায়ামের ধরন বদলে গেলেও প্রয়োজনীয়তা কমে যায় না মোটেই। আদর্শ ওজন বজায় রাখতে, বিভিন্ন রোগের আক্রমণ ও জটিলতা থেকে দূরে থাকতে, এমনকি গর্ভাবস্থায়ও (চিকিৎসকের পরামর্শমতো) ব্যায়াম করতে হয় নানা রকম জটিলতা এড়াতে। এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকার পারসোনা হেলথের (ধানমন্ডি শাখার) ডায়েটিশিয়ান অ্যান্ড ইনচার্জ শওকত আরা সাঈদা।

 

শিশু-কিশোর-

শৈশবে শরীরের ওজন ঠিক রাখতে, শক্ত হাড় গঠনে, ঘুম ঠিক রাখতে ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে ব্যায়াম। শিশুদের দিনে অন্তত এক ঘণ্টা ব্যায়ামে কাটানো উচিত। শিশুদের টইটই করে দৌড়ে বেড়ানোতেই ব্যায়াম হয়ে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলের মতো বিভিন্ন ধরনের দলগত খেলা; সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, কারাতে ইত্যাদি শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ব্যায়ামের চাহিদা মিটে যায়।

 

তরুণ আছেন যাঁরা-

খেলাধুলা, সাঁতার কাটা, সাইক্লিং, দৌড়ঝাঁপ থেকে শুরু করে প্রায় সব রকমের শরীরচর্চায় ব্যস্ত থাকতে পারেন তরুণেরা। এ ক্ষেত্রে জিমের প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারেন। একই বয়সের হলেও শারীরিক উচ্চতা, ওজনের তারতম্যের কারণে একেকজনের ক্ষেত্রে ব্যায়ামের ধরন একেক রকম হতে পারে।

 

চাকরিজীবী যাঁরা-

সকাল-সন্ধ্যা অফিস আর পারিবারিক জীবনের ব্যস্ততায় থাকেন যাঁরা, তাঁদের হয়তো নিয়মমাফিক ব্যায়াম করা হয়ে ওঠে না। তবু চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। অনেকে অফিসে চেয়ার-টেবিলে বসা চাকরি করেন, তাঁদের কাজের মধ্যেই ব্যায়াম করা উচিত। এক রুম থেকে আরেক রুমে হাঁটা, লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা, ফোনে কথা বলার সময় বসে না থেকে দাঁড়িয়ে বা একটু হেঁটে হেঁটে কথা বলা—এসবও ব্যায়াম। ঠায় বসে থাকার চেয়ে একটু ব্যায়াম তো হলো!

 

পড়ন্ত বয়সে-

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকমের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে শুরু করে। নিয়মিত কিছু ব্যায়াম সেই প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে অনেকটাই সুস্থ জীবন যাপন করতে সাহায্য করে। তবে এই বয়সে কিছুটা ভারসাম্য বজায় রেখেই ভালো থাকা যায়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি খুবই প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ন্ত্রণে, যেমন হৃদ্​রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য, হাড়ের রোগ, ব্যাকপেইন, কোলেস্টেরল লেভেল কমাতে, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে, মাংসপেশিকে শক্তিশালী করতে, অস্টিওপোরসিসের ঝুঁকি কমাতে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী হাঁটা, কিছুটা ফ্রি–হ্যান্ড, কার্ডিও টাইপ ব্যায়াম, এরোবিক্স ও ইয়োগা খুবই উপকারী।

অধিক ওজন ও বড় কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা না থাকলে অ্যারোবিক্স, তাবাতা, জুম্বার মতো শারীরিক ব্যায়ামগুলো খুবই কার্যকর এই বয়সে। এ ছাড়া যোগব্যায়াম (ইয়োগা), ধ্যান (মেডিটেশন), পাওয়ার ইয়োগা ও পিলাটিস করেও সুস্থ থাকা যায়।

 

সময় নির্ধারণ-

ঘুম থেকে ওঠার পর ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে কয়েক ঘণ্টা পর ব্যায়াম করুন।

মনে রাখবেন, কখনোই খালি পেটে ব্যায়াম করা যাবে না। সময়ের অভাব থাকলে ঘুম থেকে ওঠার আধা ঘণ্টা পর হালকা জগিং বা হাঁটতে পারেন।

তবে সকালে ভারী কোনো ব্যায়াম না করারই পরামর্শ দিলেন যমুনা ফিউচার পার্কের ফিউচার ফিটনেস জিমের প্রশিক্ষক মাহমুদুল হাসান। তিনি জানান, রাতে দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার ফলে সকালে শরীর প্রায় নির্জীব নিশ্চল থাকে। তাই এ সময়ে পেশি টানটান করা ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকা ভালো। না হয় হিতে বিপরীত হতে পারে।

দুপুরবেলা বা বেশি গরমে ব্যায়াম করলে সহজেই শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই এ সময়ে ব্যায়াম না করাই ভালো।

ব্যায়াম করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে বিকেল। যাঁদের ভারী ব্যায়ামের পরিকল্পনা রয়েছে, তাঁরা দিনের বেলার যেকোনো একটি সময় বেছে নিন। তবে দুপুরের খাবার গ্রহণের কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পরে ব্যায়াম শুরু করতে পারেন।

ব্যায়াম করার পর শরীরের তাপমাত্রা, রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। এর ফলে শরীর অধিক কর্মক্ষম থাকে এবং ক্লান্তভাব কেটে যায়। তাই ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগেই ব্যায়াম করা উচিত নয়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা হাতে নিয়ে ব্যায়াম করুন।

 

ব্যায়ামের স্থান-

খোলা জায়গায় ব্যায়াম করা সবচেয়ে ভালো। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে সবুজের মধ্যে ব্যায়ামের মাধ্যমে অনেক রোগের উপসর্গ কমে যায়। কিন্তু যান্ত্রিক এই ঢাকা শহরে সবুজে ছাওয়া উন্মুক্ত স্থানের সংখ্যা খুবই কম। সে ক্ষেত্রে আপনার কাছের কোনো জিম বা স্রেফ ঘরকেই বানিয়ে ফেলতে পারেন আপনার ব্যায়ামাগার। তবে ভালো ফল পেতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ব্যায়াম করা যেতে পারে। তবে ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভারি ব্যায়াম না করাই ভালো। কারণ, এই সময়ে শক্ত ব্যায়ামে জড়িয়ে গেলে তার জিনগত স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

 

কী খাবেন এই সময়ে?

শারীরিক ব্যায়ামের কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে ভারী খাবার খেয়ে নিতে হবে এবং খাবার খাওয়ার পরই যেমন ব্যায়াম করা যাবে না, ঠিক তেমনি ব্যায়াম শেষ করেই ভারী খাবার খাওয়া যাবে না।

 

ব্যায়ামের আগে-

জিমে বা ব্যায়ামে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে কার্বোহাইড্রেট–জাতীয় খাবার খেতে হবে। ব্যায়ামের আগে ফল খেতে পারেন। ব্যায়ামের আগে আপেল, কলা; সঙ্গে টোস্ট এগুলোও খেতে পারেন। এই খাবারগুলো হজম হতে কম সময় লাগে এবং ব্যায়ামের আগে শরীরে শক্তি জোগাবে।

তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই খালি পেটে ব্যায়াম করা যাবে না। ব্যায়ামের ফলে যে চাপ পড়বে, সেটি শরীরের শর্করার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে হাইপোগ্লেসিমিয়া হয়ে শরীর অবসন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই কখনোই খালি পেটে ব্যায়াম করতে যাবেন না।

ব্যায়াম চলাকালে বিভিন্ন ডেটক্স ওয়াটার খেতে পারেন দেহ থেকে টক্সিক পদার্থ বের করে দিতে। খেতে পারেন কাঠবাদাম, ওয়ালনাট (আখরোট), খেজুর, ডাবের পানি তাৎক্ষণিক শক্তি পেতে।

 

ব্যায়ামের পর-

ব্যায়ামের পরপর দেহের শক্তির জন্য ৫০-৬০ গ্রাম প্রোটিনের প্রয়োজন পড়ে। দুধ, ডিম, ডাল, মাংস প্রোটিনের চাহিদা মেটাবে। প্রোটিনের পাশাপাশি আঁশ–জাতীয় খাবার এবং সবুজ শাকসবজি খান।

ওজন কমাতে অনেকেই ব্যায়াম শুরু করে ভাত বা কার্বোহাইড্রেট খাবারগুলো বন্ধ করে দেয়। এটা কোনোভাবেই উচিত না। এতে শরীরের স্ট্যামিনা ও মেটাবলিজম কমে যায় এবং শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই পরিমিত সুষম খাবার অবশ্যই খেতে হবে। খাবারের মেনু থেকে যতটা সম্ভব ডুবো তেলে ভাজা খাবার, মিষ্টি, কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি খাবার বাদ দিতে হবে। কারণ, এসব খাবার খেলে আপনার ব্যায়াম করা বৃথা হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে ডায়েট পরিকল্পনার জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।



ব্যায়ামের অভ্যাস করতে-

ব্যায়াম শুরু করুন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থেকে। মনোবিজ্ঞানীরা এই দিন থেকে ব্যায়াম শুরু করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সপ্তাহের এই দিন থেকে ব্যায়াম শুরু করলে সারা সপ্তাহ এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হবে।

ব্যায়াম হিসেবে আপনি যদি সাঁতার বা সাইক্লিং করেন, তবে তা নিয়মিত করুন। মাসে একবার বা দুইবার করলে সেটি থেকে উপকার পাবেন না।

যেমন ১০ মিনিট ব্যায়াম করলেন। এটি যদি টানা তিন দিন করতে পারেন, তবে নিজেকে ছোট একটা উপহার দিন। তা হতে পারে পছন্দের কোনো খাবার। এতে আপনার ব্যায়াম করার আগ্রহ থাকবে। পরপর দুই দিন ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকবেন না। আজ হয়তো আপনি ব্যায়াম করছেন না, কিন্তু পরের দিন অবশ্যই ব্যায়াম করবেন।

ব্যায়ামকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করুন। সকালের নাশতা খাওয়ার মতো ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। ব্যায়ামকে বিকল্প মনে না করে ‘অবশ্যই করণীয়’ মনে করুন।

 

 

 

 

 

 

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো

ছবিঃ সংগৃহীত