৩৩ শতাংশ মানুষ একাকিত্বে ভোগেন
গতকাল সোমবার বিবিসি প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, ৩৩ শতাংশ মানুষ হরহামেশা একাকিত্বে ভোগেন। সব বয়সী মানুষের মধ্যে একাকিত্ব দেখা যায়। জরিপে বলা হয়েছে, ৪২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা একাকিত্ব বোধ করেন না, কদাচিৎ তাঁদের এমন বোধ হয়। ২৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন, কখনো কখনো তাঁরা একাকিত্ব বোধ করেন। আর ৩৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা বেশির ভাগ সময় একাকিত্বে ভোগেন। এ বছরের ভ্যালেন্টাইনস ডেতে (১৪ ফেব্রুয়ারি) একাকিত্বের বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য অনলাইনভিত্তিক এক জরিপ শুরু করে বিবিসি। এতে ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার ২৩৭টি দেশ, দ্বীপ ও অঞ্চলের ৫৫ হাজার মানুষ অংশ নেন। একাকিত্ব নিয়ে এটিকেই সবচেয়ে বড় জরিপ বলে ধরা হচ্ছে।
বিবিসি রেডিও ফোর লন্ডনভিত্তিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ওষুধ, চিকিৎসাবিষয়ক জাদুঘর ও গ্রন্থাগার ওয়েলকাম কালেকশনের সঙ্গে যৌথভাবে এই জরিপ পরিচালনা করে। ১ অক্টোবর জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
অনেকেই আছেন, যাঁরা নিজের সমস্যার কথা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন না। জীবনকে বন্ধুহীন মনে হয়। কষ্টের কথা নিজের ভেতর জমাট বেঁধে ঘুরপাক খায়। আবার অনেকে আছেন, যিনি কোনো সমস্যার ভেতরে নেই, তবু এমন কারও প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না, যাঁর সঙ্গে সব কথা বলা যায়। এই বোধ থেকে একসময় একাকিত্বে ভোগা শুরু করেন। জীবনের বিভিন্ন বয়সে এমন একাকিত্বে ভোগেন অনেকে। চারপাশের অনেক মানুষের মধ্যে থেকেও নিজেকে একা লাগে। একধরনের শূন্যতায় বুকের ভেতর হাহাকার করে।
একাকিত্ব ঘোচাতে ছবি এঁকে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন জ্যাক কিং। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
মানুষের একাকিত্বে ভোগার বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের যখন নিজের কথা কাউকে বলার মতো জায়গা থাকে না অথবা তাঁর কোনো ঘটনায় যেভাবে তিনি সাড়া পেতে চান, সেটি আশপাশের কোনো মানুষের কাছে পান না, তখন তিনি একাকিত্বে ভোগেন। যেসব মানুষের সামাজিক দক্ষতা, অর্থাৎ যাঁরা মানুষের সঙ্গে বেশি মিশতে পারেন, তাঁদের একা বোধ করার সুযোগ কম। অনেকে আছেন, অনেক মানুষের ভিড়ে থাকেও কারও সঙ্গে সেভাবে মিশতে পারেন না। আবার যাঁদের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি কম, তাঁরাও একাকিত্বে ভোগেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত বেশি সময় দেন যে তাঁদের বাস্তবের চেয়ে ভার্চ্যুয়াল বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারও মানুষকে একা করে দেয়। একাকিত্বে ভোগা মানুষেরা বিষণ্নতায় ভোগেন বলে জানান আহমেদ হেলাল। তিনি বলেন, একা বোধ থেকে অনেকে আত্মহত্যার দিকেও ঝুঁকে পড়েন। আবার সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক রোগে ভোগা ব্যক্তিরা একা থাকতে পছন্দ করেন। তাঁরা সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
আহমেদ হেলাল বলেন, একাকিত্ব ঘুচাতে সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু, সহকর্মী একে অন্যকে পরিমাণগত সময়ের চেয়ে গুণগত সময় বেশি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে একজন আরেকজনের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন।
‘একাকিত্ব এক গভীর যন্ত্রণা’-
বিবিসির জরিপে অংশ নেওয়া তিনজনের একাকিত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে গতকাল বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে।
ওই তিনজনের ভাষায়, একাকিত্ব থেকে একধরনের শূন্যতা বোধ তৈরি হয়। ভালো বা খারাপ যে ঘটনাই হোক না কেন, তা বলার মতো কোনো মানুষকে পাশে না পাওয়া বেশ কঠিন এক অনুভূতি। অনেকে ‘প্রকৃত আমিকে’ অন্যের সামনে প্রকাশ হতে দিতে চান না। ভেতরের সত্তাকে লুকিয়ে রেখে নিজের হাসিখুশি বাইরের চেহারাটাই দেখাতে পছন্দ করেন।
স্কুলজীবন থেকে একাকিত্বে ভোগেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেগান পল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
জরিপে অংশ নিয়েছিলেন মিশেল লয়েড (৩৩) নামের এক নারী। তিনি লন্ডনে বাস করেন। বেশ বন্ধুবৎসল। আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। নিজের চাকরিটাও পছন্দ করেন। যা চেয়েছেন, তার প্রায়ই সব পেয়েছেন। অথচ তিনিও একাকিত্ব বোধ করেন। বন্ধুরা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা ছুটির দিনে সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই পছন্দ করেন। মিশেল তাই বন্ধুদের চেয়ে সহকর্মীদের সঙ্গেই বেশি মেশেন। অফিসের কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে কোনো কোনো দিন বাইরে ঘোরাফেরা করেন, খাওয়াদাওয়া করেন। কিন্তু গভীর সম্পর্কের বিষয়টি তিনি ‘মিস’ করেন।
মিশেল বলেন, ‘আমি যে–কারও সঙ্গে গল্প করতে পছন্দ করি। তবে এর মানে এই নয় যে এই স্বভাবের কারণে আমি লোকজনের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। কিশোরী অবস্থাতেই আমি খেয়াল করে দেখেছি, কিছু না কিছু নিয়ে আমি একাকিত্ব বোধ করি। বন্ধুদের বড় গ্রুপের মধ্যে থেকেও আমি নিজেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন বোধ করি, গত পাঁচ বছরে এটা বেড়ে চলেছে।’
প্রচলিত ধারণা আছে, বয়স্ক ও বিচ্ছিন্ন মানুষেরা সাধারণত একাকিত্ব বোধ করেন। তবে বিবিসির জরিপে দেখা গেছে, তরুণদের একটি বড় অংশ একা বোধ করে এবং একা বোধ করার নমুনা প্রতিটি দেশে একই রকমের। জরিপে দেখা গেছে, তরুণেরা তুলনামূলকভাবে বয়স্কদের চেয়ে একাকিত্ব নিয়ে সহজে কথা বলতে পারেন। এরপরও অনেক তরুণ আছেন, যাঁরা একাকিত্বের বিষয়টি অন্যকে জানাতে লজ্জা পান।
বলা হয়ে থাকে, আধুনিক জীবন একাকিত্বের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তবে জরিপে নিঃসঙ্গ বয়স্ক লোকজনের অনেকে জানিয়েছেন, তাঁরাও কম বয়সে একাকিত্ব বোধ করতেন। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সে বাবা-মায়ের কড়া শাসন থেকে বেরিয়ে আসা শুরু হয়। উত্তরণের এই সময়ে এই তরুণেরা নিজেদের পরিচয় তৈরি করে, বন্ধু খোঁজে। এই বয়সী তরুণদের মধ্যে একা বোধ করার প্রবণতা বেশি।
একাকিত্ব জটিল আকার ধারণ করলে তা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। যাঁরা সব সময় বা বেশির ভাগ সময় একা বোধ করেন, তাঁদের মধ্যে অন্যকে বিশ্বাস করার প্রবণতা কম। যাঁদের মধ্যে একাকিত্ব বোধের প্রবণতা বেশি, তাঁরা কারও প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নিতে পারেন না।
একাকিত্ব ও একা সময় কাটানোর মধ্যে সম্পর্কটা বেশ জটিল। জরিপে পাওয়া গেছে, ৮৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা নিজেদের মতো হতে পছন্দ করেন। এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছেন, একা থাকতে থাকতে তাঁদের মধ্যে একাকিত্বের বোধ তৈরি হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা স্পষ্টভাবে তাঁদের মধ্যে একাকিত্বের শিকড় গেড়ে দেয়। ৪১ শতাংশ মনে করেন, একাকিত্ব কখনো কখনো ইতিবাচক।
যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দা জ্যাক কিংয়ের (৯৬) স্ত্রী মারা যান ২০১০ সালে। একাকিত্ব ঘোচাতে গল্প-কবিতা লেখা, গান শোনা আর ছবি আঁকার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জাপানে বন্দী হিসেবে তিন বছর ছিলেন। অন্য বন্দীদের বিনোদন দিতে বিভিন্ন কমিক লিখতেন এবং অভিনয় করতেন। যুদ্ধ শেষে একদিন ট্রেনে করে ফিরছিলেন, ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে এক তরুণী প্ল্যাটফর্ম থেকে চিৎকার করে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তিনি চাইলে ছবিতে তাঁকে (তরুণীকে) রাখতে পারেন। সেই থেকে পরিচয়, প্রেম, বিয়ে। ৬৫ বছরের সুখী বিবাহিত জীবনের পর একদিন তাঁর স্ত্রী স্ট্রোক করেন। ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন, মারা যান। সেই থেকে জ্যাক কিংয়ের একাকিত্ব বোধ শুরু। তাঁর মতে, একাকিত্ব হচ্ছে অনেক গভীর এক যন্ত্রণা। এটা একটি অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হয় যেন, পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। কিছুই যেন করার থাকে না।একেকটি দিনকে অনেক লম্বা মনে হয়।
তিনি বলেন, ‘আমার কোনো বন্ধু নেই, সবাই মারা গেছে। সাড়ে ৯৬ বছর বয়সে আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’
জরিপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একা বোধ করা লোকজনের কার্যকলাপও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একা বোধ করা মানুষেরা ফেসবুক অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে ব্যবহার করেন। এটাকে আরও বিনোদন ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে। তাঁদের বাস্তব জীবনের বন্ধুর সংখ্যা কম এবং অনলাইনে বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একাকিত্ব বোধের অনুভূতি আরও বাড়াতে পারে, তবে এটা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও সাহায্য করে। যেমন মিশেল যখন বেশি একা বোধ করেন, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে পড়েন। ইনস্টাগ্রামে লোকজনের আনন্দদায়ক সময় কাটানোর ছবি দেখেন। তবে সেগুলো দেখে তাঁর মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। একদিকে ভালো লাগে, অন্যদিকে মনে হয়, কেন তিনি এমন জীবন পান না ?
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো