জামদানির শাড়ি ও পোশাক
থিম, মোটিফ, নকশা, ফেব্রিকস—সব শাখায় বাঙালির একান্ত নিজস্ব ম্যাটেরিয়াল জামদানির জৌলুস চিরকালীন। মোগল আমল থেকে হালফ্যাশন, সমান জনপ্রিয় জামদানি এখন শুধু শাড়িই নয়, ব্যবহূত হচ্ছে অন্য পোশাকেও।
জামদানি শাড়ি বা ফেব্রিকসের নকশায় সাধারণত দুটি অংশ থাকে। পাড় ও জমিন। জামদানিতে তিন ধরনের ডিজাইন হয়—বুটা, জাল ও তেছরি। এই তিন ডিজাইনে আবার হরেক রকম নকশা হতে পারে। জামদানিতে পাড় আর জমিনের নকশায়ও ভিন্নতা থাকে। নকশার সূক্ষ্মতার ওপর ভিত্তি করে জামদানির দাম নির্ধারণ হয়। অবশ্য জামদানির মান বিচারে ফেব্রিকসের সুতাও একটা বড় বিষয়। হাফসিল্ক ও সুতি দুই ধরনের জামদানি হয়। রেশমের টানা ও সুতির পোড়নে বুননে তৈরি হয় হাফসিল্ক জামদানি। আর টানা ও পোড়নে উভয় ক্ষেত্রেই সুতার বুননে তৈরি হয় সুতি জামদানি।
বাজার ঘুরে দেখা গেল, হাল ফ্যাশনে ফেব্রিকসের চেয়ে জামদানি মোটিফ বেশি জনপ্রিয়। ময়ূরকণ্ঠী, পুঁইপাতা, কলকা, দুবলা, বেলপাতা, ইঞ্চি, জুঁই, বেলি, শাপলা, গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলেল ও জ্যামিতিক নকশা পোশাকে ব্যবহার হচ্ছে।
কখনো প্রিন্ট, কখনো আবার এমব্রয়ডারির নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে জামদানির চিরায়ত এই মোটিফগুলো। সালোয়ার-কামিজের পাশাপাশি কুর্তা, টপস, স্কার্ট, লেহেঙ্গা ও গাউনের মতো পোশাক ডিজাইন হচ্ছে জামদানি মোটিফে। শুধু মেয়ে নয়, আছে ছেলেদের পোশাকও। পাঞ্জাবি, ফতুয়া এমনকি ক্যাজুয়াল শার্টেও ব্যবহার হচ্ছে জামদানি। হ্যান্ডলুম তাঁতে বোনা জামদানির মোটিফ তুলে এনে স্ক্রিন, ব্লক বা এমব্রয়ডারিসহ অন্যান্য ডিজাইন মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন ডিজাইনাররা। জমকালো পোশাক ডিজাইনে জামদানির নিজস্ব নকশার পাশাপাশি আরো থাকছে এপ্লিক, জারদৌসি, সিকোয়েন্স, পুঁতি বা মুক্তার নকশা। বেশির ভাগই উত্সবে পরার উপযোগী পার্টি পোশাক। দেশীয় জামদানি আর পাশ্চাত্যের ফ্যাশনের ফিউশন ফুটে উঠছে জমকালো পোশাকে। জামদানি খুব স্বচ্ছ ও স্পর্শকাতর ফেব্রিকস। সে কারণেই পোশাক ডিজাইনে সরাসরি জামদানি ফেব্রিকস কম দেখা যায়। তবে শাড়িতে এখনো হাতে বোনা জামদানির কদরই বেশি।
বিশ্বরঙের ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বললেন, ‘আমাদের ফ্যাশন ঐতিহ্যে জামদানির ব্যবহার অতি প্রাচীন। আন্তর্জাতিক ফ্যাশনেও জামদানির বিশেষ কদর রয়েছে। জামদানি নিয়ে আমাদের দেশীয় ডিজাইনারদের নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের দেশের বিয়ের বাজার অনকেখানি বিদেশি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির দখলে। এই বাজারকে দেশীয় ফ্যাশনে ফেরাতে জামদানি নিয়ে কাজ করছি। বিগত কয়েক বছর ধরে বিয়েতে কনের পরনে জামদানি শাড়ির একটা ট্রেন্ড আমরা দেখেছি। শাড়ি ছাড়াও অনেকে লেহেঙ্গা বা কামিজ স্কার্ট পরছেন। এসব পোশাকে জামদানিকে তুলে আনতে পারলে পোশাকে যেমন নতুনত্ব আসবে তেমনি দেশিয় ফ্যাশন প্রতিষ্ঠা পাবে। তাই বিয়ে ও অন্যান্য জমকালো উত্সবের পোশাক ডিজাইনে জামদানিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ফিউশন ডিজাইনে ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে জামদানিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’
জামদানির পৃষ্ঠপোষকতা ও এর মোটিফকে আধুনিক আঙ্গিকে উপস্থাপনে প্রতিবছর ফ্যাশন হাউস অঞ্জন’স আয়োজন করে জামদানি প্রদর্শনী। জামদানি মোটিফের আধুনিকায়ন নিয়ে অঞ্জনসের প্রধান ডিজাইনার শাহীন আহমেদ বললেন, ‘জামদানি শাড়ি তার নিজস্ব বুনন নকশায়ই বেশি জনপ্রিয়। এখানে অন্য ডিজাইন মাধ্যম যোগ করা কিংবা বাড়তি ভ্যালু অ্যাড করার প্রয়োজন নেই বলেই আমি মনে করি। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দের ভিত্তিতে আলাদা করে পাড় বসানো বা সীমিত পরিসরে ফিউশন নকশা হতে পারে। পোশাকে মূলত জামদানির মোটিফ নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জামদানি মোটিফের সুবিধা হলো সবগুলোই প্রায় জিওমেট্রিক মোটিফ। তাই এই কাজগুলো যখন ফ্রেম, এমব্রয়ডারিসহ অন্য মাধ্যমে ডিজাইন করা যেমন সহজ তেমনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলাও সম্ভব হয়। গত কয়েক বছর ধরে জামদানিকে আধুনিক আঙ্গিকে উপস্থাপনে এই মোটিফগুলোই ছেলে-মেয়ে উভয়ের পোশাকেই নানাভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।’
দেশীয় ফ্যাশন হাউসের অনেকেই কাজ করছে জামদানি মোটিফ নিয়ে। আড়ং, অঞ্জন’স, বিশ্বরঙ, কে ক্রাফট, রঙবাংলাদেশ, বাংলার মেলা, বিবিআনা, সাদাকালোসহ প্রায় সব ফ্যাশন হাউসেই পাবেন এ ধরনের কামিজ-কুর্তা, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও টপস। ফ্যাশন হাউসে তৈরি পোশাক ছাড়াও বিয়ে বা যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য ক্রেতার মনমতো জামদানি শাড়ি ও কাস্টমাইজড পোশাক তৈরি করে দিচ্ছেন দেশীয় ডিজাইনররা। তবে সে জন্য বেশ কিছু সময় হাতে রেখে ফ্যাশন হাউসের সঙ্গে করতে হবে যোগাযোগ।
সুত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ